ক্রেডিট স্কোর কী এবং এটি কীভাবে আপনার ঋণ গ্রহণের সক্ষমতাকে প্রভাবিত করে?

ক্রেডিট স্কোর কী এবং এটি কীভাবে আপনার ঋণ গ্রহণের সক্ষমতাকে প্রভাবিত করে?

বর্তমান বিশ্বে আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে ক্রেডিট স্কোর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি একটি সংখ্যা যা আপনার ঋণ পরিশোধের ইতিহাস, বর্তমান ঋণের পরিমাণ এবং আর্থিক শৃঙ্খলাকে প্রতিফলিত করে। ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান এই স্কোরের ভিত্তিতে ঋণ প্রদান ও সুদের হার নির্ধারণ করে। তাই আপনি যদি ভবিষ্যতে গাড়ি, বাড়ি বা বড় কোনো বিনিয়োগের জন্য ঋণ নিতে চান, তবে একটি ভালো ক্রেডিট স্কোর থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

একটি ভালো ক্রেডিট স্কোর আপনাকে কম সুদের হারে ঋণ গ্রহণের সুযোগ তৈরি করে দেয়, যা দীর্ঘমেয়াদে আপনার জন্য অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী হতে পারে। অপরদিকে, কম স্কোর থাকলে ঋণের আবেদন বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বা উচ্চ সুদের হারে ঋণ গ্রহণ করতে হয়। ফলে, নিজের ক্রেডিট স্কোর সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং এটি উন্নত করার কৌশল জানা অত্যাবশ্যক।

এই প্রবন্ধে আমরা বিস্তারিতভাবে জানবো ক্রেডিট স্কোর কী, কীভাবে এটি নির্ধারিত হয়, ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে এর প্রভাব কী এবং কীভাবে আপনি এটি উন্নত করতে পারেন।

Table of Contents

ক্রেডিট স্কোর কী?

ক্রেডিট স্কোরের ধারণা বোঝানোর জন্য একটি গ্রাফ বা স্কেল, যেখানে ভালো ও খারাপ স্কোরের পার্থক্য দেখানো হয়েছে।

ক্রেডিট স্কোর সাধারণত ৩০০ থেকে ৮৫০-এর মধ্যে একটি সংখ্যা, যা ব্যক্তির আর্থিক আচরণকে প্রতিফলিত করে। উচ্চ স্কোর নির্দেশ করে যে ব্যক্তিটি ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য। বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্রেডিট রিপোর্টিং সংস্থা ব্যক্তির ক্রেডিট স্কোর বিশ্লেষণ করে। এটি মূলত ব্যক্তির আর্থিক অভ্যাস এবং ঋণ ব্যবস্থাপনার দক্ষতা নির্ধারণ করে।

ক্রেডিট স্কোর নির্ধারণের উপাদানসমূহ

ক্রেডিট স্কোর গণনার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রয়েছে। প্রধান পাঁচটি উপাদান হলো:

  • পরিশোধের ইতিহাস (৩৫%) – সময়মতো ঋণ পরিশোধ করলে স্কোর ভালো থাকে, অন্যথায় স্কোর কমে যেতে পারে।
  • ক্রেডিট ব্যবহারের হার (৩০%) – আপনার মোট ক্রেডিট সীমার কত শতাংশ ব্যবহার করছেন, তা স্কোরের উপর প্রভাব ফেলে। কম ব্যবহার করলেই ভালো স্কোর পাওয়া যায়।
  • ক্রেডিট ইতিহাসের বয়স (১৫%) – পুরনো ক্রেডিট অ্যাকাউন্ট থাকলে এটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
  • নতুন ক্রেডিট গ্রহণ (১০%) – যদি অনেক বেশি নতুন ঋণ আবেদন করা হয়, তাহলে স্কোর কমে যেতে পারে।
  • ক্রেডিটের ধরন (১০%) – বিভিন্ন ধরনের ঋণ যেমন পার্সোনাল লোন, গাড়ির লোন, ক্রেডিট কার্ড ইত্যাদি থাকলে এটি স্কোর উন্নত করতে সাহায্য করে।

ক্রেডিট স্কোরের পরিসীমা ও এর প্রভাব

স্কোর পরিসীমামূল্যায়ন
৩০০-৫৭৯খুব খারাপ
৫৮০-৬৬৯গড়পড়তা
৬৭০-৭৩৯ভালো
৭৪০-৭৯৯খুব ভালো
৮০০-৮৫০চমৎকার

যাদের স্কোর ৭০০ বা তার বেশি, তারা সহজেই কম সুদে ঋণ পেতে পারেন। অন্যদিকে, ৬০০-এর নিচে স্কোর থাকলে ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে যায়।

ক্রেডিট স্কোর কিভাবে ঋণ গ্রহণে প্রভাব ফেলে?

  • ঋণ অনুমোদনের সম্ভাবনা: উচ্চ স্কোর থাকলে ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
  • সুদের হার: উচ্চ স্কোর মানেই কম সুদের হার।
  • ক্রেডিট লিমিট: ভালো স্কোর থাকলে ব্যাংক উচ্চ ঋণসীমা অনুমোদন করতে পারে।
  • ঋণদাতার আস্থা: ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে স্কোর বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেয়।
  • ঋণের শর্তাবলী: কম স্কোর থাকলে ঋণের শর্ত কঠোর হতে পারে, যেমন উচ্চ সুদের হার ও ছোট ঋণের পরিমাণ।

কীভাবে ক্রেডিট স্কোর উন্নত করবেন?

ক্রেডিট স্কোর উন্নত করার উপায়গুলোর তালিকা, যেমন সময়মতো ঋণ পরিশোধ, কম ক্রেডিট ব্যবহার, এবং নিয়মিত স্কোর পর্যবেক্ষণ।
  • সময়মতো ঋণ ও বিল পরিশোধ করুন।
  • ক্রেডিট কার্ডের ব্যালেন্স কম রাখুন।
  • নতুন ঋণের জন্য অতিরিক্ত আবেদন করা এড়িয়ে চলুন।
  • পুরাতন ক্রেডিট অ্যাকাউন্ট খোলা রাখুন।
  • নিজের ক্রেডিট রিপোর্ট নিয়মিত পর্যালোচনা করুন এবং ভুল থাকলে সংশোধন করুন।
  • অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন।
  • অপ্রয়োজনীয় ক্রেডিট কার্ড গ্রহণ করবেন না।
  • ঋণ পুনঃতফসিলীকরণের সুযোগ গ্রহণ করুন।
  • সঠিক ব্যয় পরিকল্পনা করুন।
  • আর্থিক শিক্ষা অর্জন করুন এবং বাজেট পরিকল্পনা মেনে চলুন।

বাংলাদেশে ক্রেডিট স্কোর ব্যবস্থা

বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (CIB) ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ঋণ সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণ করে। যদিও বাংলাদেশে ব্যক্তিগত ক্রেডিট স্কোরের ব্যবহার এখনও সীমিত, তবে অনেক ব্যাংক ও Non-Banking Financial Institution (NBFI) এটি ব্যবহার করছে। ভবিষ্যতে এই সিস্টেম আরও জনপ্রিয় হবে বলে আশা করা যায়।

ক্রেডিট স্কোর সম্পর্কে সাধারণ ভুল ধারণা ও বাস্তব সত্য

ক্রেডিট স্কোর নিয়ে সাধারণ ভুল ধারণাগুলোর তালিকা, যেমন 'বেশি ক্রেডিট কার্ড থাকলে স্কোর কমে যায়' বা 'বারবার স্কোর চেক করলে স্কোর কমে যায়'।

ক্রেডিট স্কোর সম্পর্কে আমাদের সমাজে কিছু ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। এই ধারণাগুলো প্রায়শই মানুষকে বিভ্রান্ত করে এবং ভুল সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। নিচে কয়েকটি প্রচলিত ভুল ধারণা এবং এর পেছনের বাস্তবতা তুলে ধরা হলো:

ভুল ধারণা: সব ঋণই খারাপ

বাস্তবতা: সব ঋণ খারাপ নয়। যদি সময়মতো পরিশোধ করা হয়, তাহলে এটি আপনার ক্রেডিট স্কোর উন্নত করতে পারে। যেমন, গৃহঋণ বা শিক্ষাঋণ দীর্ঘমেয়াদে ভালো ক্রেডিট ইতিহাস তৈরি করতে সাহায্য করে।

ভুল ধারণা: একবার স্কোর কমে গেলে আর বাড়ানো সম্ভব নয়

বাস্তবতা: ক্রেডিট স্কোর পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। সময়মতো ঋণ পরিশোধ, কম ক্রেডিট ইউটিলাইজেশন (৩০% এর নিচে রাখা) এবং পুরনো ক্রেডিট হিস্ট্রি ধরে রাখলে স্কোর ধীরে ধীরে উন্নত হয়।

ভুল ধারণা: ক্রেডিট কার্ড থাকলে স্কোর কমে যায়

বাস্তবতা: ক্রেডিট কার্ড থাকলেই স্কোর কমে যায় এটা ভাবা অনুচিত। বরং নিয়মিত বিল পরিশোধ এবং লিমিটের কম ব্যবহার (৩০%-এর কম) করলে স্কোর ভালো হয়।

ভুল ধারণা: উচ্চ আয় মানেই ভালো ক্রেডিট স্কোর

বাস্তবতা: উচ্চ আয়ের সঙ্গে সরাসরি ক্রেডিট স্কোরের কোনো সম্পর্ক নেই। যদি ঋণ পরিশোধে অবহেলা করেন বা নিয়মিত বিল পরিশোধ না করেন তবে উচ্চ আয় থাকা সত্ত্বেও ক্রেডিট স্কোর কমে যেতে পারে।

ভুল ধারণা: স্কোর কমে গেলে পুনরুদ্ধার কঠিন

বাস্তবতা: ধাপে ধাপে আর্থিক শৃঙ্খলা অনুসরণ করলে স্কোর পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। নিয়মিত পরিশোধ, নতুন ঋণের আবেদন কমানো এবং ক্রেডিট রিপোর্টে ভুল সংশোধন করলে স্কোর ধীরে ধীরে বাড়তে পারে।

ভুল ধারণা: ক্রেডিট স্কোর শুধু ঋণ পাওয়ার জন্য দরকারি

বাস্তবতা: ক্রেডিট স্কোর শুধু ঋণ পাওয়ার জন্যই নয়, এটি আপনার আর্থিক জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োজন। যেমন – বীমা, বাড়ি ভাড়া, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে চাকরির ক্ষেত্রেও আপনার ক্রেডিট স্কোর দেখা হয়। খারাপ ক্রেডিট স্কোর আপনার জীবনযাত্রার মানকে অনেকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।

ভুল ধারণা: ক্রেডিট রিপোর্ট চেক করলে স্কোর কমে যায়

বাস্তবতা: ক্রেডিট রিপোর্ট চেক করলে স্কোর কমে না। বরং ক্রেডিট রিপোর্ট চেক করে আপনি আপনার রিপোর্টে কোনো ভুল থাকলে তা সংশোধন করতে পারবেন, যা আপনার স্কোরকে উন্নত করতে সাহায্য করবে। আপনি বছরে একবার বিনামূল্যে আপনার ক্রেডিট রিপোর্ট চেক করতে পারবেন।

ভুল ধারণা: ক্রেডিট স্কোর গোপনীয় তথ্য, তাই এটা কারো সাথে শেয়ার করা উচিত না

বাস্তবতা: আপনার ক্রেডিট স্কোর আপনার ব্যক্তিগত আর্থিক অবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আপনি চাইলে আপনার বিশ্বস্ত কারো সাথে এটি নিয়ে আলোচনা করতে পারেন, বিশেষ করে যদি আপনি আর্থিক পরামর্শ নিতে চান। তবে অবশ্যই আপনার ক্রেডিট রিপোর্ট এবং স্কোর অন্য কারো হাতে দেওয়ার আগে সাবধান থাকতে হবে।

উপসংহার

একটি ভালো ক্রেডিট স্কোর ঋণ গ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি করে এবং কম সুদের হারে ঋণ পেতে সাহায্য করে। এটি ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে। সঠিক পরিকল্পনা ও সচেতনতা থাকলে যে কেউ তার ক্রেডিট স্কোর উন্নত করতে পারবে।

বর্তমান বিশ্বে আর্থিক সাফল্যের জন্য একটি ভালো ক্রেডিট স্কোর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু ঋণ গ্রহণের সুবিধা দেয় না, বরং ফিন্যান্সিয়াল ডিসিপ্লিন গঠনে সহায়তা করে। ভবিষ্যতে বড় ধরনের বিনিয়োগ বা সম্পদ কেনার পরিকল্পনা থাকলে এখন থেকেই ভালো ক্রেডিট স্কোর গঠনে মনোযোগ দেওয়া উচিত। সঠিক বাজেট পরিকল্পনা, নিয়মিত ঋণ পরিশোধ এবং সুপরিকল্পিত ব্যয় ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এটি অর্জন করা সম্ভব। তাই নিজের ক্রেডিট স্কোর সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং এর উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কীওয়ার্ড: ক্রেডিট স্কোর, ক্রেডিট স্কোর কী, ক্রেডিট স্কোর কত হওয়া উচিত, ক্রেডিট স্কোর চেক, ক্রেডিট স্কোর কিভাবে বাড়ানো যায়, ক্রেডিট রিপোর্ট, বাংলাদেশে ক্রেডিট স্কোর